Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিনিধি: সিলেট নগরে ডেঙ্গুর শঙ্কা মাঝে বেড়েছে মশার উপদ্রবও। নগরবাসী মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। লোকজন বলছেন, মশকনিধন কার্যক্রমে ঢিলেমির কারণে মশার যন্ত্রণা বড়েছে। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, ঢিলেমি নয়, বৈরী আবাহাওয়ার কারণে কিছুটা হোঁচট খেয়েছে মশক নিধন কার্যক্রম।
সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিশেষায়িত কাজ। এ কাজ কীটতত্ত¡বিদের। কিন্তু সিলেট সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত¡বিদ নেই। সিলেটে এটির কোন পদও নেই, লোকও নেই। যার ফলে টেকনিকাল বিষয়ের সমাধানগুলো যথাযথ ভাবে হচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে অধিক মশার লার্ভা জন্মালেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা হয় না, তাই মশক নিধনে কার্যত কোন ‘ফিডব্যাক’ আসেনা নগরে। এ বিষয়ে সিলেট /সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা.মো: জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশনে কীটতত্ববিদের কোন পদ নেই। তবে এ পদ না থাকলেও আমরা এডিস মশা কি, এর লার্ভা কি-তা আমরা শিখেছি এবং এগুলো আইডেনটিফাই বা শনাক্ত করতে পারি। তবুও কীটতত্ত্ববিদের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তিনি।
কীটতত্ববিদ কেন প্রয়োজন: মশাবাহিত রোগ ছড়ানোর পেছনে নানা কারণ বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়। আর মশা-মাছিবাহিত রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে মশা-মাছির গতি-প্রকৃতি ও জীবনাচার দেখভালের দায়িত্বে থাকার কথা কীটতত্ত্ববিদদের। মশাবাহিত কোনো না কোনো রোগের প্রকোপ-কোথাও চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু কোথাও ম্যালেরিয়া আবার কোথাও কালাজ্বর কিংবা ফাইলেরিয়া। কীটতত্তবিদরা মশা-মাছির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে মশা নিধন কার্যক্রমও পরিচালনা করে থাকেন তারা। এ ছাড়া কীটনাশকের মানও তারাই পরীক্ষা করেন ফিল্ডটেস্টের মাধ্যমে কিন্তু সিলেট সিটি করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কীটতত্ত্ববিদ নেই। ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চলে মশা নিধন কার্যক্রম। এতে আশানুরূপ সুফল পায় না নগরবাসী। এদিকে, এখন চলছে বর্ষা মৌসুম। নগরে তাই বেড়েছে মশার উপদ্রব ডেঙ্গুর প্রকোপের মাঝে এই উপদ্রব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। তাই নতুন এ দুর্যোগ এড়াতে হলে মশকনিধন কার্যক্রমে ঢিলেমি দেওয়া যাবে না বলে মনে করেন তারা। মশকনিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।
মশার উপস্থিতি জানার জন্য সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা প্রতিবছর তিনটি জরিপ করে। বর্ষা মৌসুমের আগে, বর্ষা মৌসুমের সময় এবং বর্ষার শেষে। এই জরিপ হয় মূলত ঢাকা শহরে। কিন্তু ঢাকার বাইরে এই জরিপ হয়না। অথচ এই তিনটি জরিপ থেকে মশা পরিস্থিতির কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
এদিকে, ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মাঝে সিলেটে বেড়েছে মশার উপদ্রবও। কিন্তু মশা নিধনে যেন সবসময়ই অসহায় সিটি করপোরেশন। বরাবরই তাদের জবাব ‘আমরা বসে নেই’। প্রতিদিনই কাজ চলছে।
নগরীর শিবগঞ্জ, রায়নগর, বাদাম বাগিচা, তেররতনসহ বিভিন্ন এলাকার অনেকে এ বলেন, মশার উৎপাত এত বেড়েছে যে, রাতে কোথাও শান্তিতে দুই মিনিট দাঁড়ানোর উপায় নেই। ঘরে-বাইরে একই অবস্থা। মশার কয়েল জ্বালিয়েও ঘরে দুই মিনিট শান্তিতে বসা যায় না।
বাসিন্দাদের এমন অভিযোগের মাঝে গতকাল বুধবারও বাদাম বাগিচার একটি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পেয়েছে সিটি করপোরেশন। এর আগে ওসমানী হাসপাতাল ও রাগিব-রাবেয়া হাসপাতালে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ডেঙ্গুআক্রান্ত সিলেটে একশ পেরিয়ে যায়।
তবুও কি সিটি করপোরেশন উদাসিন এমন প্রশ্ন ছিলো সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে। তিনি বলেন, মশক নিধনে এখন আবহাওয়া ‘সুইটেবল’ (উপযোগী) নয়। ওষুধ ছিটানোর সময় হঠাৎ বৃষ্টি চলে আসে, এতে ওষুধ নষ্ট হয়। তবুও আমরা কাজ করছি। ফগার চলছে। আরো ৫/৬টি ফগার গাড়ি বাড়ানো হবে।
এদিকে, প্রতিবছরই নগরের মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছর ডেঙ্গু নিয়ে কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা শুরু হয় বর্ষা মৌসুমে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর। সমস্যার আপাত সমাধানে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কাজ করা হয় অনেকটা অস্থায়ী ভিত্তিতে। ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হলে এডিস মশার বিষয়গুলো আর মনে থাকে না-এমনাটই মনে করেন নগরবাসী।
আগে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশা শুধু দিনে কামড়াত, এখন রাতে কামড়ানোর চিত্রও দেখা যাচ্ছে। এ মশা আগে ডিম পাড়ত স্বচ্ছ পানিতে, এখন ডিম পাড়ছে ময়লা পানিতেও। এতটাই বদলে গেছে এডিস মশার আচরণ আর তাতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শঙ্কা। এমন পরিপেক্ষিতে ভয়ংকর হয়ে উঠছে দেশের ডেঙ্গুপরিস্থিতি। প্রতিদিন ডেঙ্গুআক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানামুখী চাপে আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে এডিস মশা। কীটনাশকনির্ভর মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে এ মশা। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। তখন থেকেই প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অল্পবিস্তর ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হতে থাকে। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুপরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন থেকে একটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে ডেঙ্গু। চলতি বছরও সারা দেশে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গুরোগের জীবাণুবাহক এডিস মশা অল্প অল্প করে তার আচরণ বদলাচ্ছে। তাতেই নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা।
এডিস মশার আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, আগে এ মশাটি শুধু দিনে কামড়াত। সম্প্রতি কয়েক বছরে দেখা গেছে মশাটি রাতেও কামড়াতে পারে। আগে এ মশা শুধু স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ত। এখন এটি ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ছে। এডিস মশার আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে ডেঙ্গুর লণেও। চিকিৎসকরা বলছেন, আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচÐ জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসত। কিন্তু এখন জ্বর কম থাকলেও শক বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও।
ঠিক কী কী কারণে এডিস মশা তার আচরণ বদলেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘নানামুখী চাপে এডিস মশা তার আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে। মূলত মশাটি বাঁচার তাগিদেই তার কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে কীটনাশক বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। সম্পর্ক আছে অপরিকল্পিত নগরায়ণেরও। সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের ওপর বেশি নির্ভর করছে। আমরা বহু আগে থেকেই বলে আসছি শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য পুরো বছর পরিকল্পিত কাজ করতে হবে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প পথ নেই।’
কীটনাশক ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণ মশার আচরণ বদলাতে ভুমিকা রাখছে বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক ড.কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্মায় নগরায়ণের কারণে ওইসব জায়গায় যখন পরিবর্তন আসে, তখন এডিস সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। বিশেষ করে রাতে যখন বাসাবাড়িতে উজ্জ্বল আলো জ্বলে তখন মশা দিনের মতোই কামড়াতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্বচ্ছ পানির জলাধার কমে গেলে মশা বাঁচার তাগিদেই নোংরা পানিতে ডিম পাড়তে অভ্যস্ত হয়ে যায়।’
মশার আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর উপসর্গেও পরিবর্তন এসেছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অতিমাত্রায় কীটনাশক ছিটানো হলে মশার দেহে এটা সহনশীল হয়ে যায়। ফলে একটা সময় আর কীটনাশকে মশা মরে না। শুধু মশা নয়, সব ভাইরাসই অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে নিজেকে ওই ওষুধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে যায়। ফলে আমরা দেখছি ডেঙ্গু রোগীরও উপসর্গ বদলে গেছে। আগে ডেঙ্গুতে এত মানুষ মারা যেত না। এখন কিন্তু মৃত্যুর হার বাড়ছে। আগে রোগীর প্রচÐ জ্বর হতো। ১০৩-৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠত। এখন দেখা যায় ১০০-১০১ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে রোগী আসছেন। এখন রোগীদের পেটে ব্যথা হয়। আগে এমনটা দেখিনি। অল্পতেই রোগী শকে চলে যায় এবং মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এগুলো সবই মশা ও ভাইরাসের আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘ডিএসসিসি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেই কীটনাশক প্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়।’ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত নন বলেও মন্তব্য করেন।
৭১০ পড়েছেন