Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: বহু আলোচিত-সমালোচিত সেই এসিল্যান্ড ফয়সাল আহমেদ এখন কানাইঘাটে। তিনি ২০২১ সালের ২৭ জুলাই দোয়ারাবাজারের এসিল্যান্ড হিসাবে যোগদান করে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্পে দূর্নীতি,আওয়ামীলীগ নেতাদের মামলা দিয়ে হয়রানী, অন্যায় কাজে প্রতিবাদ করায় ইউপি সদস দের নামের মামলা দিয়ে হয়রানীসহ ক্ষমতার সব রকম অপব্যবহার আর দুর্নীতি করে গেছেন। এরকম নানা অভিযোগে তাকে হঠাৎ করে বদলী করা হয় সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। ফলে দোয়ারাবাজার এলাকা জুড়ে স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন ভোক্তভোগীরা। বদলি খবর শুনেই অনেকটা নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন এই এসিল্যান্ড।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত দুই বছরে নামজারির নামে গলাকাটা ব্যবসা, মোবাইল কোর্টের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি, জলমহাল থেকে অবৈধ সুবিধাগ্রহণ, সরকারি নিয়ম বহির্র্ভূত কাজে সম্পৃক্ততা, দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ, জামাত শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্যতা, বিভিন্ন নদীর বালি ও সীমান্তের পাথর নিলামে অনিয়ম এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা লোকজনকে সুবিধা দেওয়ার কথা বলে উপজেলা সদরে শিশু পার্কের নামে তাঁদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০২২ সালের ১২ আগস্ট উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৭টি ঘর এই এসিল্যান্ড ফয়সাল আহমদ এলাকাবাসীর আপত্তি থাকা স্বত্বেও নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেন দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য তাজির উদ্দিনকে। তিনি ছিলেন একজন বিতর্কিত ইউপি সদস্য। তার বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতি রয়েছে।
আজমপুরস্থ আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজের শুরুতেই নির্মাণ কাজে অনিয়ম দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা এসিল্যান্ডের নিয়োগকৃত তাজির উদ্দিনের কাজে বাধা দেন। এতে এসিল্যান্ড ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ দিয়ে উপজেলার এক আওয়ামীলীগ নেতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেন। যদি স্থানীয়দের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের ছাড়তে বাধ্য হন। এর কয়েক দিন পর রাতের আধারে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে রড ছাড়াই ঢালাইয়ের কাজ শুরু করলে, স্থানীয় লোকজন প্রশাসনকে খবর দিলে রাতেই তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা প্রিয়াঙ্কার হস্তক্ষেপে আংশিক নির্মাণকৃত ছয়টি ঘর ভাঙ্গা হয়। মিলে অনিয়মের সত্যতা। অন্যদিকে একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে লক্ষীপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গাপারা গ্রামের আরফান আলী নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে স্থানীয় এক দালাল এসিল্যান্ডকে দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকা নেয়। পরে তার বাড়িতে ঘর নির্মাণের সামগ্রীও পাঠানো হয়। কিন্তু টাকা নিয়েও ঘর নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হলে ভুক্তভোগী প্রতিকার চেয়ে ইউএনও’র কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করায় এসিল্যান্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ভূক্তভোগী আরফান আলীকে ভূমি অফিসে ডেকে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেন।দায়িত্বপালন কালে এরকমই একাধিক তুলকালামকাÐ ঘটিয়েছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়সাল আহমেদ। চলতি বছরের মে মাসে উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে নদী খনন প্রকল্পের ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভরাট করা পুকুরের বালি প্রকাশ্যে বিক্রি করে একটি সিন্ডিকেট।অভিযোগ উঠে এসিল্যান্ডের যোগসাজশেই ওই সিন্ডিকেট চক্র অবাধে লাখ লাখ টাকার বালু বিক্রি করেছে।
একই মাসে উপজেলা সদরে মৎস্য ব্যবসায়ীদের মাছ ঘরের পাশে নৌকা ভিড়ানোর জায়গা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে মোরগ ব্যবসায়ীদের ঘর নির্মাণের আচমকা নির্দেশ দিয়ে দেন। এনিয়ে এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও ধর্মঘট পালন করেন মাছ ব্যবসায়ীরা। পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে বিষয়টি আপোস মিমাংসা করা হয়।
এদিকে তিনি যোগদানের পরপরই উপজেলা সদরের ভূমি অফিস সংলগ্ন একটি দোকানে ভূমি অফিসের জায়গাতে দোকানপাট করার অভিযোগ এনে লাল পতাকা টানিয়ে দেন এবং উচ্ছেদেরও নোটিশ দেন এসিল্যান্ড। এর কয়েক দিন পরেই অদৃশ্য কারণে নিষেধাজ্ঞা ও উচ্ছেদ কার্যক্রম কার্যক্রম ভেস্তে যায়। পওে জানা যায় এসিল্যান্ডকে ম্যানেজ করে নিয়েছিলেন সেখানের ব্যবসায়ীরা।
উপজেলার চিলাই নদীতে বালুখেকো সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠলে এসিল্যান্ড ফয়সাল দায়সারা কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে উল্টো বালুখেকোদের সাথেই তাঁর অফিসের কর্মচারীদের মাধ্যমে গোপন ব্যবসায় মেতে উঠেন। পরবর্তীতে গণমাধ্যমকর্মীদের চাপে অভিযান চালিয়ে উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের বাগমারা এলাকা থেকে দুটি ড্রেজার মেশিন (বোমা মেশিন) জব্দ করে ভূমি অফিসে নিয়ে আসেন। কিন্তু এর একদিন পরেই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রাতের আধাওে ড্রেজারগুলো ফেরত নিয়ে যায় বালুখেকোরা।
একইভাবে এসিল্যান্ডের দায়িত্বকালে তিনি জলমহাল থেকে অবৈধ মাছধরার জাল অফিসে নিয়ে আসলেও দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে অফিস থেকে ছেড়েদেন।
গত ২০ জুলাই তার বদলি নির্দেশনা আসার পরে উপজেলার বাঁশতলা হকনগর পর্যটন এলাকায় অবৈধভাবে পাথরখেকো সিন্ডিকেট পাথর উত্তোলন করলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৪৫ হাজার ফুট পাথরকে ৭৫০০ ফুট দেখিয়ে ওই পাথর খেকো সিন্ডিকেটের কাছেই মাত্র ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিলাম দেন। তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে তার অফিসের লোকজন দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের আইসিটি আইনে মামলা দেওয়ার হুমকি তিনি।
১৯ জুলাই সুরমা ইউনিয়নের টিলাগাঁও রাবার ড্যামের ওপর দিয়ে খাসিয়ামারা নদীর বালু মহালের ইজারাদারের লোকজন নৌকা ও ড্রেজার মেশিন পারাপার করতে গেলে রাবারের ক্ষতির আশঙ্কায় স্থানীয় কৃষকরা বাধা দেন। এঘটনায় এসিল্যান্ড ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত হয়ে ইজারাদারের পক্ষ নিয়ে তিনি রাবারের ওপর দিয়ে নৌকা পারাপারের সুযোগ করে দিতে গেলে ক্ষুব্দ হয়ে এলাকাবাসী প্রতিবাদ মিছিল করে। যার জন্য এসিল্যান্ড ক্ষুব্ধ হয়ে এক ইউপি সদস্যসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাঁধা প্রদানের অজুহাত এনে হয়রানিমূলক একটি মামলা করে একজনকে জেলহাজতে পাঠান। যার জন্য এলাকাবাসী সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনসহ, উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
কয়েক মাস পূর্বে উপজেলা ভূমি অফিসের সরকারি কার্যালয় ব্যবহার করে জাকঝমকপূর্ণ বিবাহ বার্ষিকী পালন করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সমালোনা শুরু হয়।
এই ফয়সাল আহমদ এসিল্যান্ড পদে উপজেলায় যোগদানের পর থেকে ভূমি অফিসের অতিথি কক্ষে স্বপরিবারে বসবাস করতেন। তিনি গত দুই বছরে বিদ্যুৎ বিলসহ ভূমি অফিসের সরকারি অতিথি কক্ষের কোন রকম ভাড়া প্রদান করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার অফিসের এক কর্মচারি বলেন, এসিল্যান্ড শুরু থেকেই ভূমি অফিসের অতিথি কক্ষে স্বপরিবারে বসবাস করতেন, নিয়ম বহিভূত ভাবে। তার বেতনের সাথে বাসাভাড়া যুক্ত থাকলেও তিনি আজোঅবধি বাসা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেননি।
সম্প্রতি বিপি সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেওয়ার নামে উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের শ্যামলবাজারে শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজে ব্যয়ের কথা বলে দুইপক্ষের কাছ থেকেই বড় অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠে। টাকা নিয়েও কোনো পক্ষেরই কাজ করেন নি তিনি। তার বদলি নির্দেশনার পরেও দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে তিনি ছুটির দিনসহ মধ্যরাত পর্যন্ত অফিস করেছেন, এবং মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে ভূমি অফিসে ভীড় করতে দেখা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে তিনি বাদী বিবাদীকে নোটিশ না দিয়েই নিয়মবহির্ভূত ভাবে একতরফা নামজারি, খারিজ জমা ভাগ ও সরকারি ভূমি বন্দোবস্ত দিয়েছেন। ভুক্তভোগী অনেকেই জানিয়েছেন, তাদের নোটিশ না দিয়েই রাতের আধারে তাড়াহুড়ো করে এসিল্যান্ড অন্তত শতাধিক নামজারি এবং বন্দোবস্ত দিয়েছেন। যারা সুবিধা দিয়েছিলেন তাদের কাজ একদিনেই করে দিয়েছেন আর যারা দিতে পারেননি না তাদের কাজ ঝুলে আছে।
সম্প্রতি উপজেলার সদর ইউনিয়নের রাখালকান্দি গ্রামের এক ব্যক্তিকে শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজে ২০ ব্যাগ সিমেন্ট দেওয়ার প্রতিশ্রæতি নিয়ে টেবিলে বসে বিপি সম্পত্তি লিজ দিয়ে দেন। পরে ওই ব্যক্তি প্রতিশ্রæতি মোতাবেক ২০ ব্যাগ সিমেন্ট না দেওয়ায় ভূমি অফিসের অফিস সহকারী আব্দুস শহীদের মাধ্যমে দুদিন পরেই প্রতিপক্ষ সাজিয়ে আরেকটি দরখাস্ত করানো হয়।
অপর দিকে সরকারি যেকোনো ক্রয় সংক্রান্ত কাজে ক্রয় নীতিমালা (পিপি আর) অনুযায়ী দরপত্র আহবান করতে হয়। এসব কাজের জন্য উপজেলা প্রকৌশলীকে প্ল্যান ও রেইট সিডিউল দিতে হয় এবং মাসিক সমন্বয় সভায় তা অনুমোদন করাতে হয়। কিন্তু উপজেলা সদরের শিশু পার্ক নির্মাণের কাজে নির্মাণ সামগ্রী ও ভূমি অফিসের আসবাবপত্র ক্রয়ে কোনো ধরণের দরপত্র আহবান, উপজেলা প্রকৌশল অফিসের প্ল্যান কিংবা রেইট সিডিউল কোনোটিই নেওয়া হয়নি। সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে এসিল্যান্ড নিজেই তার মনগড়া মতো সরাসরি এসব কাজ করেছেন।
উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ইদনপুর গ্রামের নজির আহমদ বলেন, বিপি সম্পত্তি আমার নামে বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজের কথা বলে এসিল্যান্ড ভূমি অফিসের কর্মচারীদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন। কিন্তু এখনো আমার নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি অথচ তিনি কানাইঘাটে বদলী হয়ে চলে গেছেন।
সুরমা ইউনিয়নের ০৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি আবুল খায়ের বলেন, ‘সুরমা ইউনিয়নের আলীপুরে মুজিব কেল্লা নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থানের জমির উন্নয়ন কাজ শুরু করলে এসিল্যান্ড বার-বার বাধা দিয়ে কাজের ব্যাঘাত ঘটান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আরিফ মোর্শেদ মিশুর কাছে এসিল্যান্ডের নানা কর্মকাÐ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ’শিশু পার্কে সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। অধিকন্তু ভূমি অফিস কাম আবাসিক কক্ষের ভাড়া বিদ্যুৎ বিল দেওয়া এগুলো একান্তই প্রশাসনিক বিষয়, সাংবাদিকদের জানার বিষয় নয়।
এখন দেখার বিষয় কানাইঘাটে যোগদান করে এসিল্যান্ড ফয়সাল কি করেন।
৬৯৪ পড়েছেন