• ১লা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৭ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ৯ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

সাদা পাথর লুট: পরিদর্শনের মন্ত্রী পরিষদের টিম : আজ থেকে এ্যাকশনে নতুন ডিসি: ২৪ ঘন্টায় ৭শ ট্রাক লুট করে সবেদ বাহিনী: জড়িত প্রশাসনের ৮ টি দপ্তর

admin
প্রকাশিত আগস্ট ২৬, ২০২৫
সাদা পাথর লুট: পরিদর্শনের মন্ত্রী পরিষদের টিম : আজ থেকে এ্যাকশনে নতুন ডিসি: ২৪ ঘন্টায় ৭শ ট্রাক লুট করে সবেদ বাহিনী: জড়িত প্রশাসনের ৮ টি দপ্তর

Sharing is caring!

বিশেষ প্রতিনিধি : অবশেষে মঙ্গলবার লুটকৃত সাদাপাথর পর্যটন স্পট পরিদর্শন করেছে পাথর লুটের ঘটনায় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার সকালে সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব জাহেদা পারভীনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যদের দলটি সাদাপাথর এলাকায় যান। এসময় তারা সাদাপপাথর এলাকা ঘুরে দেখেন। কথা বলেন স্থানীয় লোকজন, ব্যাবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে। এর আগে প্রথমে রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকার পরিদর্শন করেন তারা। এসময় সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারসহ বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। গত ২০ আগস্ট মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব জাহেদা পারভীনের নেতৃত্বে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত আছেন। কমিটি ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবে। এদিকে, পাথর ফেরত দিতে জেলা প্রশাসনের ৩ দিনের আল্টিমেটাম শেষ হয়েছে সোমবার। প্রশাসনের বিভিন্ন সুত্র বলছে, এ পর্যন্ত লুট হওয়া ২৫ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা গেছে। এর মধ্যে ৬ লাখ ঘনফুট পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিস্থাপনের জন্য ভোলাগঞ্জের ১০ নং ঘাট এলাকায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে আরও ৭ লাখ ঘনফুট পাথর। পর্যায়ক্রমে উদ্ধারকৃত পাথরগুলো সাদাপাথর পর্যটন স্পটে প্রতিস্থাপন করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম। গত ১৩ আগস্ট দদকের সিলেট কার্যালয়ের উপ পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাতের নেতৃত্বে একটি টিম সাদাপাথর পরিদর্শন করে। এরপর তারা ১৬ আগষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে সাদাপাথর লুটে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা মিলিয়ে ৫৩ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাথর আত্মসাতের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশ ছিল। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় ইতোমধ্যে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদকে ওএসডি ও কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়েছে। সাদাপাথর লুট নিয়ে গত ১৭ আগস্ট পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “এখানে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে, এর বিপরীতে প্রশাসনের হয় যোগসাজশ করেছে, নতুবা নীরব থেকেছে অথবা দুটোই ঘটেছে। এজন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব এবং দ্রুতই নেব।” সিলেটের সাদাপাথর থেকে লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের দেয়া তিন দিনের আল্টিমেটামের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট)। আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর থেকেই শুরু হচ্ছে প্রশাসনের চিরুনি অভিযান।


অবৈধভাবে উত্তোলিত ও মাটিচাপা দিয়ে লুকানো পাথর শনাক্ত ও উদ্ধার করা, পাথর ব্যবসায়ী ও দখলদারদের আইনের আওতায় আনা, উদ্ধার করা পাথর প্রকৃত স্থানে প্রতিস্থাপন এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এ অভিযানে অংশ নেবে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ বাহিনী। জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম জানিয়েছেন, পাথর লুটে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক পরিচয় বা প্রভাবের কারণে কেউ রেহাই পাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে প্রকৃতির ক্ষতিসাধনকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়। প্রশাসনের হুঁশিয়ারি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময় শেষে কারও কাছে সাদা পাথর পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি যে এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাথর উদ্ধার হবে, সেই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসন সরওয়ার হোসেন যোগদান করেই আলোচিত সাদা পাথর এলাকা পরিদর্শন করে লুটের সত্যতা পান। এইদিন সাদাপাথর এলাকায় দাড়িয়েই কঠিন হুশিয়ারী দেন লুটকারীদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ঘোষনা দেন গতকাল মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বিকেল ৫টার মধ্যে লুট হওয়া সাদা পাথর নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে লুটকারীরা যেনো পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথরে পৌঁছে দেওয়ার। অন্যথায় সাদা পাথর অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়, সংরক্ষণ এবং পরিবহনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৫টার মধ্যে ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর ঘাট ডাম্পিং স্টেশনে নিজ উদ্যোগে পাথর ফেরত পাঠাতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাথর ফেরত দিতে বৈঠক করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে। চলছে মাইকিং। শুধু সাদা পাথর নয় সেই সঙ্গে লুট হয়ে গেছে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলাও। ১৩৬ একরের এই টিলাটি পুরো নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। এই টিলা ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় ২৬ সদস্যের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চক্রে রয়েছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সাদা পাথর লুটকান্ডে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৫২ নেতাকর্মীর নাম আসলেই সেই তালিকাই নেই ট্রাক শ্রমিক নেতা সবেদ মিয়ার নাম। সবেদ মিয়ার বাড়ি গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকার নয়াবস্তি গ্রামে। জাফলং এলাকার পাথর লুটকান্ডের মাস্টার মাইন্ড সবেদ মিয়া তার গড ফাদার বিএনপি থেকে বহিস্কৃত জেলার নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরানের কথায় মাত্র ২৪ ঘন্টায় ৭শত ট্রাক পাথর সরিয়ে নেয় সাদা পাথর এলাকা থেকে। যদিও সূত্র বলছে, এমন খবরে বিষয়টি নিয়ে তারা তদন্ত করছে। ট্রাক শ্রমিকের সাথে যুক্ত অনেকে বলছেন এই সবেদ মিয়াকে গ্রেফতার করলে সাদা পাথর লুটের অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। কারন সরকার পতনের পর জাফলং এলাকায় ২শত কোটি টাকার পাথর লুট হয় এই সবেদ মিয়ার নেতৃত্বে। কারণ সবেদ মিয়ার কথা ছাড়া কোন কোয়ারী ভেছালাগঞ্জ, জাফলং এলাকায় একটি ট্রাকও প্রবেশ করেনা।
এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে সাদাপাথর লুটকান্ডে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী এবং পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, উপজেলা সাবেক চার নির্বাহী অফিসার, থানার সাবেক ওসি ও বর্তমান ওসির দায় দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। লুটকাণ্ডে একের পর এক বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। পাথর লুটে জড়িত ১২জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সিলেট বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে, সিলেট জেলা প্রশাসক (ডিসি), কোম্পানীগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিলেট পুলিশ সুপার (এসপি), কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং কোম্পানীগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সরাসরি মদদ ছিল পাথর লুটপাটে। পাথর চুরির ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক কোম্পানীগঞ্জের বিদায়ী চার নির্বাহী কর্মকর্তা যথাক্রমে আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাসনাত, উর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা, সিলেটের পুলিশ সুপার, কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ও বিজিবি’ পরিবশে অধিদপ্তরের কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টিও উঠে আসে দুদকের প্রতিবেদনে। এ ছাড়া টাকার ভাগ পেয়েছেন জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট পুলিশ ইন্টার্নাল ওভারসাইটের (পিআইও) দুজন কর্মকর্তা। লুটের ঘটনায় ইতোমধ্যে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদকে ওএসডি ও কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়েছে। তবে স্বপদেই আছেন বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ সুপার ও থানার ওসি উজায়ের আদনান। সাদাপাথর লুট বন্ধে ‘ব্যবস্থা নেননি’ চার ইউএনও। পাথর লুটপাটের ঘটনায় বিজিবির দায়িত্বে অবহেলা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে বিজিবির সদর দপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুবায়ের আনোয়ার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিত টাস্কফোর্সের অভিযান অধিক পরিমাণে চালানো হলে এত ব্যাপক লুটপাট হতো না।’ ১৯ বিজিবি অধিনায়ক বলেন, ‘সাদাপাথর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত মহল বিজিবি সম্পর্কে নানা ধরনের অপতথ্য প্রচার করছে। বিজিবি সার্বক্ষণিকভাবে তাদের আওতাধীন এলাকায় টহল অব্যাহত রেখেছে। সর্বশেষ পাথর লুট কান্ডে ফেঁসে যেতে পারেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ সুপার, থানার ওসি সহ অনেক কর্মকর্তা।
কি আছে জেলা প্রশাসনের রিপোর্টে: সাদাপাথর লুটের ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ রিপোর্টে পাথর লুটের ঘটনায় ১৩৭ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া গঠিত তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে; পাথর সমৃদ্ধ এলাকা হলেও সিলেটে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর কোনো নিজস্ব কার্যালয় নেই। এখানে ব্যুরোর পক্ষ থেকে একটি কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। লুট হওয়া সাদাপাথর স্বস্থানে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয় ওই রিপোর্টে। এ প্রস্তাবের কার্যক্রম এখনো চলছে। এ ছাড়া পরিবেশ রক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ করা এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারা টিম নিয়োজিত করা হয় ও বিজিবিকে সক্রিয় রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। জেলা পুলিশের মনিটরিং টিম: সাদাপাথর লুটের ঘটনার পর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করছেন কিনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে কিনা এসব বিষয় মনিটরিং করছে ওই টিম। সিলেটের এডিশনাল এসপি মো. রফিকুল ইসলাম জানান- মনিটরিং টিমের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। একইসঙ্গে পাথর লুটের ঘটনায় ইতিমধ্যে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে সেগুলোর আসামি গ্রেপ্তার ও তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে। থানায় দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের দিকে পুলিশ বেশি করে নজর দিয়েছে বলে জানান তিনি।

১৮৩ পড়েছেন