Sharing is caring!

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সেই সমিতির ইজারাপ্রাপ্তির কাগজে দেখা যায়, মজিদপুরের হিলাল আহমদের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়েছে। এতেই প্রমান হয় জালিয়াতির মাধ্যমে উক্ত সমিতির নামে বিলটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। অথচ এই সমিতির দূরত্ব বিল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার কুশিয়ারা নদীর ওপারে অবস্থান। এ সময় আশার আলোর পক্ষ থেকে সোহেল আহমদের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি এই সমিতির সভাপতি ও সাধারণকে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন, যেখানে লেখা রয়েছে, শৈলেশ্বর ও বিলডোবা দুটি বিল অকৃষি হিসাবে শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং “চট্টগ্রাম সেনানিবাস পূর্বাঞ্চল” ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। এ রকম কয়েকটি কাগজ এ প্রতিবেদক সংগ্রহ করেন। পরে আশার আলো সমিতি এই বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট মামলা করলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার একটি প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও আদালতকে জানিয়েছিলেন, এ সংক্রান্ত কোন চিটি বা আদেশ তিনি পাননি। সেনানিবাসের নামে বন্দোবস্তের কাগজটি ভুয়া। এই কাগজটি সোহেলের যোগ সাজসে সৃজন করেছে কতিপয় একটি চক্র। যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বোকা বানানো হয়েছিলো।পরে অবশ্য দুটি বিলের মধ্যে বিলডুবা ইজারা দেওয়া হয় খালোপার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির অনুকুলে আর শৈলেশ্বর বিলটি ইজারা দেওয়া হয় একই গ্রামের দিশারী মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির অনুকুলে। অথচ এই দুটি সমিতির সকল কাগজপত্র জাল ও জালিয়াতীর মাধ্যমে সৃজনকৃত, যা তৈরী করতে সার্বিকভাবে সহযোগীতা করেন সোহেল আহমদ নিজে। অপরদিকে আশার আলো মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি নিয়ম মাফিক দরপত্রের সাথে রাষ্ট্রিয় কোষাঘারে টাকাও জমা দেয়। তখন নাকি সোহেল দাবী করেছিলেন, যদি দুটি বিল আশার আলো মৎস্যজীবি সমবায় সমিতিকে ইজারা নিতে হয়, তাহলে প্রতিবছর তাকে ৫০% শেয়ার দিতে হবে।চলতি বছরে শৈলেশ্বর বিলটি ইজারা প্রদানের জন্য ডিসি অফিস দরপত্র আহবান করলে, সেখানেও অংশ নেয় খালোপার গ্রামের প্রতিশ্রæতি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। সকল নিয়ম মেনে তারা দরপত্র জামা প্রদান করেছেন। একই ভাবে আবারও সোহেলের যোগসাজসে জাল-কাগজ সৃজন করে ইজারায় অংশ নিয়েছে সেই আলোচিত দিশারী মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি খালোপার। তবে এখানে দেখা যায়, প্রতিশ্রুতি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সর্বচ্চ দরদাতা। কিন্তু সোহেলকে ম্যানেজ করে নিয়েছে দিশারী মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও সোহেল বিলটি তাদের অনুকুলে লিজ দিতে কাজ করে যাচ্ছেন গোপনে। কারণ দিশারী মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সাথে সোহেল রয়েছেন ২৫% অংশিদার।
আরও পড়ুন — বিল–জলমহাল ইজারায় ভয়াবহ অনিয়ম: সিলেট ডিসি অফিসে সোহেল আহমদের একক নিয়ন্ত্রণ
একই ভাবে সিলেট সদরের সর্বানন্দ মৌজা অবস্তিত ২৮৪.০৭ একরের মেলান বিল। এ বছর ইজারামূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু এ বিলটিতে ১৯৯৮ সাল থেকে মামলাভুক্ত দেখনো হয়েছে। যদিও বিগত ২০০৬ সাল থেকে বিলটি ছিলো আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল এর দখলে। বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর বিলটি দখলে নেয় আরেকটি চক্র। এই বিলটি সঠিক ভাবে ইজারা দিলে প্রতি বছর সরকারের ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ বিলের পাশ্ববর্তী ৮৮.০৫ একরের মাকুলি বিল। এ বছর দর হাকা হয়েছে ৬ লাখ ৬ লাখ২হাজার ২২০ টাকা। বাস্তবে বিলের ৭৫ % জমি বিভিন্ন ব্যক্তি জবর দখল করে নিয়েছে। ফলে এ বিলটির আকৃতি বদল করে ফেলা হয়েছে। ডিসি অফিসের সেই তালিকা অনুযায়ী প্রায় ৪০টি বিল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সরকারের শত-শত একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। এসব বিল ও জলমহাল থেকে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব। কৌশলে অফিসের পিয়ন সোহেল হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সদর উপজেলার হাটখলা ইউনিয়নের হাকুলি-মাকুলি জলমহাল। এবার দরহাকা হয়েছে ৬ লাখ টাকায়। কাগজে কলমে বিলটি বিগত বছরে হাটখোলা সোনার বাংলা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি সদর সিলেটের অনুকুলে। প্রথম ৪ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয় ৮ লাখ টাকা করে। পরের ২ বছর আরো ২৫% বৃদ্ধি করা হবে।কিন্তু সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, এটি সম্পন্ন ভুয়া লিজের কাগজ। বিগত বছর বিলটি খাসকানেশনের মাধ্যমে লুটপাট করা হয়েছে। চলতি বছরে বিলটি আবার খাসকানেকশনের জন্য দরহাকা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে যদি বিলটি ৬ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আবার বছরের-বছরের খাসকানেকশনের জন্য কেন দরহাকা হচ্ছে। সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার উপজেলার হাওয়াচেরা বিলটি ইজারা প্রদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের পাওয়া গেছে। এ বিশাল বিলের আয়তন ৮০.৩০ একর। ২০২৩ সালে সেই বিলে খাসকানেকশন হয়েছে ১১ লাখ টাকা। পরের বছর ২০২৪ সালে সেই বিল ইজারা দেওয়া হয় মাত্র ৫ লাখ টাকায়। বিলটি ইজারা পায় স্থানীয় প্রত্যাশা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করে বসে, স্থানীয় নতুনকুড়ি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ও গোপালগাঁও মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি। সেখানে সোহেলের যোগসাজসের কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়। এই বিল নিয়ে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারী ২০২৫ ইং তারিখে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিটপিটিশন মামলা দায়ের করেন নতুনকুড়ি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির প্রতিনিধি মোগলাবাজার থানার গোপালগাঁও গ্রামের মৃত রইছ আলীর পক্ষে লেবু মিয়া। যাহার মামলা নং-৪০১/২০২৫ ইং। উক্ত মামলায় উল্লেখ করা হয়, সিলেট জেলা প্রশাসক অফিসের পিয়ন সোহেল ও কর্মকর্তারা সকলের যোগসাজসে দীর্ঘদিন থেকে জেলার জলমহাল-বিল ইজারা ও খাসকানেকশনের নামে লুটপাট চালিয়ে আসছে। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এবারও সেই বিল ইজারা দরহাকা হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা।গোয়াইনঘাট উপজেলার নিজাইল খাড়াঢিগা গ্রুপ জলমহালের জমির পরিমান ৪শত ৫৪ একর জমির বিলটি ইজারা নিতে স্থানীয় ৩টি সমিতি অংশ নেয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে লিজ না দিয়ে ইজারার জন্য দরপত্র আহবান করেন তিন বছরের জন্য। এ সময় সোহেল প্রায় ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ উঠে। কিন্তু একই বছর সেই বিলের জমির পরিমান দেখানো হয়েছে মাত্র ২শত ৯০ একর। বিলের অবশিষ্ট জমি জনৈক ব্যক্তিকে কন্ট্রাক্টে বন্দোবস্ত দিয়েছেন সোহেল আহমদ, সেই জমিগুলো সরকারি ১নং খতিয়ানের অর্ন্তভুক্ত।এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবি সমিতির সিলেট জেলার প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম জানান, সিলেট জেলার প্রতিটি জলমহাল-বিল ইজারা প্রদান ও খাসকানেকশনের নামে ব্যাপক লুটপাট করছেন ডিসি অফিসের পিয়ন সোহেল আহমদ। জেলার মামলাভুক্ত ৭৮টি বিল ও জলমহাল মামলা ভুক্ত থাকলেও এবিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা জেলা প্রশাসন অফিস। চাইলেই জেলা প্রশাসন মাত্র একবছরের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি সম্ভব বলে আমি মনে করি। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোরদাবী জানান তিনি।এ ব্যাপারে জেলার একাধিক মৎস্যজীবি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, সোহেল আহমদকে টাকা দিলে সমিতির কাগজপত্র সঠিক না থাকলেও ভুয়া সমিতি দিয়ে বিল ও জলমহাল ইজারা পায়। সোহেলকে ম্যানেজ করতে নাপারলে সমিতির কাগজপত্র সঠিক থাকলেও বিল-জলমহাল কোনটিরই ইজারা বা বন্দোবস্ত পায়না সমিতি। দরপত্র জমা দিতে যদি কোন সমিতির কোন একটি মাদ্রাক্ষরিক ভ‚ল হয়ে যায়, সেই অযু হাতে সর্বচ্চ দরদাতা সমিতিও ইজারা থেকে বাতিল হয়ে যায়। পরে সেখানে নতুন করে দেখানো হয় সোহেলের সাথে চুক্তিকরা অপর আরেকটি সমিতিকে। কোন নিয়মনীতি ছাড়া বিশাল-বিশাল বিল-জলমহাল ইজারা, লিজ ও বন্দোবস্ত পেয়ে যায়। সমিতির নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করে বলেন, জেলার প্রতিটি বিল-জলমহালে সোহেলের একটি কমিশন থাকে। খাসকানেকশনের জন্য যে সকল সমিতির অনুকুলে বিলগুলো ইজারা দেওয়া হয়, সেই সকল বিলগুলোর কাগজপত্র সঠিক না থাকলেও সোহেল ম্যানেজ হলে ইজারা পায় সেই সকল মৎস্যজীবি সমিতি।যদিও সম্প্রতি সিলেট জেলা প্রশাসক মো.সরোওয়ার আলম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, নিজের অফিসসহ জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্টানের দূর্নীতি, ঘুষ ও অনিয়ম ধরতে নিজের অফিসের সামনে একটি অভিযোগ বক্স স্থাপন করবেন। সেখানে যে কোন ব্যক্তি অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগকারীর নাম পরিচয় গোপন রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি সিলেটের বর্তমান জেলা প্রশাসক সরোওয়ার আলম এবার নিজের অফিসের এই দূর্নীতিবাজ পিয়নের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি প্রদক্ষেপ নিবেন জেলার মামলাভুক্ত বিলগুলোকে মুক্ত করার।
১৯ পড়েছেন