• ২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৫শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

সিলেট সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে চলে ওপেন ঘুষ বাণিজ্য

admin
প্রকাশিত এপ্রিল ৩০, ২০২৫
সিলেট সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে চলে ওপেন ঘুষ বাণিজ্য

Sharing is caring!

স্টাফ রির্পোটার:
সিলেট জেলা সাব রেজিষ্ট্রার অফিসে চলছে ওপেন ঘুষ বাণিজ্য। সরকারের পরিবর্তনের সাথে সাথে বেড়েছে ঘুষের মাত্রা। বিভিন্ন অযুহাতে ওপেন ঘুষ গ্রহণ করছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অনেকে আবার জাল সনদ দিয়ে চাকরি করছেন একযুগের বেশী সময় থেকে। বিশেষ করে জেলা রেজিষ্ট্রার জহুরুল ইসলাম, সাব রেজিষ্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জয়নাল আবেদীন, প্রধান সহকারী মকবুল হোসেন, কম্পিউটার অপারেটর শাহজাদা রিয়াদ, রেকর্ড কিপার আলী রাজা মিলে গড়ে তুলেছেন ঘুষের একটি সিন্ডিকেট। সারাদিনের ঘুষের টাকা রাতে অফিসে বসেই চলে ভাগ-বন্টনের কাজ। এদিকে সিলেট সদর সাব রেজিষ্ট্রারি অফিসে দলিল রেজিষ্ট্রারি করার জন্য পে-অর্ডারের মাধ্যমে সরকারি ফি জমা দেওয়ার পরও অতিরিক্ত আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ বেশ পুরোনো। দলিলের নকল উত্তোলেনে সরকারি ফিসের পাশাপাশি প্রতিটি নকলে অতিরিক্ত ৪৫ টাকা করে আদায় করেন সাব-রেজিষ্ট্রার, জেলা রেজিষ্ট্রার জেলা রেজিষ্ট্রারের প্রধান সহকারী কম্পিউটার অপারেটর ও রেকর্ড কিপার। এ আইনটি অবশ্য তারা নিজেরাই তৈরী করে নিয়েছেন। যার ফলে সাধারণ জনগনের পাশাপাশি দলিল লেখকরাও ভুক্তভোগীর সম্মুখিন হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন দলিল লেখা বা উত্তোলনের জন্য আমরা সরকারি নির্ধারিত ফি দিচ্ছি যেখানে, সেখানে ওপেন ভাবে অতিরিক্ত টাকা কেন নিচ্ছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। গত বুধবার সরেজমিন রেজিস্ট্রার অফিসে গেলে দেখা যায়, শফিকুল ইসলাম সুজন নামে এক ব্যক্তি চারটি নকলের সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করে সরকারি ফি জমা দিয়েছেন। কিন্তু অতিরিক্ত ঘুষের ৪৫ টাকা না দেওয়ায় সাবরেজিষ্ট্রারের রেকর্ড কিপার নকলে স্বাক্ষর করছেন না। অনেক তর্কবির্তকের পর অতিরিক্ত ৪৫ টাকা করে ঘুষ দিয়ে অবশেষে শফিকুল ইসলাম তার নকল গ্রহণ করেন। এভাবে প্রতিদিন শত শত ভোক্তভোগীকে সরকারি ফি ছাড়াও অতিরিক্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে এসব কর্মকর্তা কর্মচারীকে। রেকর্ড কিপারের সাফ বক্তব্য বড় স্যাররা ঘুষের টাকাটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাই দিন শেষে তাদের হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয়। এ দিকে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এই অতিরিক্ত ৪৫ টাকা ফি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এই টাকা না দিলে বড় স্যাররা সাক্ষর দিতে না করেছেন। তাই টাকা না পেলে সাব রেজিষ্ট্রারের রেকর্ড কিপার নকলে স্বাক্ষর করেন না বলে দলিল লেখকদের অভিযোগ।
অতিরিক্ত ৪৫ টাকা না হলে জেলা রেজিষ্ট্রার প্রধান সহকারী কম্পিউটার অপারেটর নকলে স্বাক্ষর করেন না। উনারা কিসের জন্য এই এই ঘুষ নেন এর কোনো সদুত্তর কোন দলিল লিখক দিতে পারেন নি। সম্প্রতি এমন একটি ভুক্তভোগী সম্মুখিন হন এক দলিল লেখক। তাকে নকল গ্রহিতা সরাসরি প্রশ্ন করে সরকারি ফি দেওয়ার পর কেন অতিরিক্ত ৪৫ টাকা করে নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি সুদউত্তর দিতে পারেননি। ফলে ঐ গ্রহিতার কাছে বিব্রতহন এই দলিল লেখক। এদিকে সিলেট সদর সাব-রেজিস্টিারি অফিসে শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে দলিল লেখকের লাইসেন্স করে এক যুগ ধরে দলিল লেখক হিসাবে কাজ করছেন মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ। তিনি ২০১৩ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সুপারিশেই দলিল লেখকের লাইসেন্সটি পান। তার সনদ নম্বর ৩১৭। বর্তমানে তিনি দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদেও রয়েছেন। আওয়ামী সরকারের আমলে রাশেদ খান মেননের সুপারিশে চাকরি পেলেও গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভোল পাল্টিয়েছেন রাশেদ। বর্তমানে তিনি সিলেট বিমানবন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক। জানা যায়, দলিল লেখকের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য রাশেদ যে আবেদন করেছেন, তাতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধিনে দ্যা এইডেড হাইস্কুল থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন। ওই সার্টিফিকেটে তার রোল নম্বর ৩০৭৬৭৯ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১০৩০৪৩ দেওয়া ছিল। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ শিক্ষা মন্ত্রাণলয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে ওই রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর খোঁজ করলে সেটা দিয়ে কোনো ফলাফল আসেনি।  ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ইং তার দলিল লেখক সনদ প্রাপ্তির আবেদনে তিনি লিখেছেন, তিনি একজন দরিদ্র পরিবারের লোক। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৭ জন। তিনি ছাড়া তার পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কোনো ব্যক্তি নেই। তিনি পাঁচ বছর ধরে সিলেট সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক মো. আলম মিয়ার সঙ্গে সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তাকে সিলেট সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত কাজ করতে হয়। তাই তার দলিল লেখক সনদ একান্ত প্রয়োজন। ওই আবেদনপত্রে তিনি তার জীবন বৃত্তান্ত উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি সংযুক্তি হিসেবে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনের ফটোকপি জমা দিয়েছেন। ওই আবেদনপত্রের ঠিক উপরের ডান পাশে তৎকালীন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের সিল ও স্বাক্ষরসহ কলম দিয়ে লিখে দিয়েছেন বিশেষ বিবেচনার জন্য সুপারিশ করছি। পরবর্তী সময়ে এসএসসি পাসের জাল সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি দলিল লেখক হিসেবে সনদ লাভ করেন। এদিকে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারস্থ দ্যা এইডেড হাইস্কুলের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে ৫০ জন ছাত্র পাস করলেও মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ নামের কোনো শিক্ষার্থীর নাম নেই। ২০০৬ সালে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন মোট ২২৯ জন শিক্ষার্থী। তার মধ্যে মানবিক শাখায় ৫০ জন, বিজ্ঞান শাখায় ১০৯ জন এবং বাণিজ্য শাখায় ৭০ জন পাস করেছেন। তবে কোথাও শিক্ষার্থী হিসেবে রাশেদের নাম পাওয়া যায়নি। এই বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই সিলেট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ব্যাপক তুলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি রাশেদকে আওয়ামী লীগের দোসর দাবি করে ও জালিয়াতির অভিযোগে চলতি বছরের গত ৮ এপ্রিল সিলেটের সাব-রেজিস্ট্রার বরাবরে শফিকুল ইসলাম সুজন নামের এক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগও করেছেন। ওই অভিযোগ জেলা রেজিস্ট্রার আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শফিকুল ইসলাম সুজনের লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি এসএসসির জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ২০১৩ সালে দলিল লেখকের সনদ (নং ৩১৭) পেয়েছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের নেতাদের মদদে সনদ পেয়ে সিলেট সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ, দুর্নীতি ও জালিয়াতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছেন।  ‘রাশেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালীন তিনি ভ‚য়া সার্টিফিকেট দিয়ে দলিল লেখক সনদ নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি আর্থিক লেনদেন করে সিলেটের বিমানবন্দর থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হয়েছেন। এই বিষয়ে আমি ইতোমধ্যে লিখিত অভিযোগও করেছি। বিষয়টি আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এ ব্যাপারে সিলেট জেলা রেজিস্ট্রার মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ তবে তিনি তার মদদে অফিসে প্রতিটি নকলে ৪৫ টাকা গ্রহণের বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদের খোঁজে তার অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার পরিচিতজনরা বলছেন, জাল সনদের খবর সামনে আসার পর তিনি তার নিয়মিত ব্যবহার করা মোবাইল ফোনটি বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়েছেন।

৩৬ পড়েছেন