• ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৩ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

এসএমপিতে অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ : কোন অপরাধী পুলিশকে ছাড় দেওয়া হবেনা বলে কমিশনারের হুশিয়ারি

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
এসএমপিতে অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ : কোন অপরাধী পুলিশকে ছাড় দেওয়া হবেনা বলে কমিশনারের হুশিয়ারি

Sharing is caring!

আব্দুল হালিম সাগর বিশেষ প্রতিবেদন : অভিযোগের শেষ নেই। অভিযোগের পর হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত হয় অভিযোগে। কিন্তু শাস্তি হিসাবে প্রত্যাহার, সাময়িক বরখাস্ত, বদলি, লঘুদন্ড আর গুরুদন্ড দেওয়া হয় অভিযুক্তদের। কিন্তু অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদনই থেকে যায় আড়ালে। আবার শাস্তির বদলে পুরস্কৃতও করা হয় অভিযুক্তদের, দেওয়া হয় পদন্নতি। বলছি বাংলাদেশের সর্বচ্চ শৃংখল পুলিশ বাহিনীর কথা। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনার পর প্রত্যাহার, সাময়িক বরখাস্ত, বদলি এর মধ্যেই আটকে আছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীর শাস্তির কার্যক্রম। আর সেই সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধ মুলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সরকারি এ সংস্থাটি এখন নানা প্রশ্নের মুখে। পুলিশের অপরাধ প্রমাণের পরে মাঝেমধ্যে শাস্তি হলেও থেমে নেই পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। সিলেটের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় সময়েই চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, আটক করে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগের মাত্রা যেনো বেড়েই চলেছে। কিছু কিছু অভিযোগ পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নজরে আসলেও অনেক ঘটনাই থেকে যায় লোক চক্ষুর আড়ালে। রাজনৈতিক তদবিরে বদলি এবং পদোন্নতির কারণে অনেক পুলিশ সদস্যই তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পর্যন্ত পাত্তা দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা ধরনের ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধে ব্যাপকহারে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির পুলিশ সদস্যরা। ইতিমধ্যে এমন কয়েকটি মারাত্মক অপরাধের ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেফতারও হয়েছেন সারাদেশে। বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীনও হয়েছেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। কিন্তু কেন? পুলিশের মতো একটি গৌরবময় শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনীতে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে এমন প্রশ্নে সাবেক কয়েকজন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শাস্তির বদলে পুরষ্কার আর রাজনৈতীক তদবির রক্ষা করতে গেলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। মেট্টোপলিটন এলাকায় অপরাধ পুলিশের অপরাধ প্রবনতা রুখতে সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসিদের ক্ষমতা তাদের হাতে দিতে হবে। তেমনি রেঞ্জের ডিআইজিকে অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপিদের হাতে তাদের ক্ষমতা দিতে হবে। তাহলে অধিনস্ত পুলিশ সদস্যরা অপরাধে জড়াতে ভয় পাবে। অনেক সময় কমিশনার-ডিআইজি পর্যন্ত অপরাধী পুলিশ সদস্যর অপরাধের খবর পৌঁছায় না ফলে তাদের শাস্তি ও হয়না। আর অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুতর অপরাধ করেও অনেক ক্ষেত্রে ‘একশ্রেণির প্রভাবশালী’ পুলিশ সদস্য পার পেয়ে যাচ্ছেন রাজনৈতীক তদবীরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় অভিযোগ রুজু হলেও অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তি হিসেবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ‘লঘুদন্ড’র আওতায় দেওয়া হচ্ছে সাধারণ ‘তিরস্কার’ বা ভৎর্সনা। যে শাস্তিকে অনেকেই ‘দায় এড়ানো’ বলেও মনে করছেন।
সাম্প্রতিক এরকম একাধিক ঘটনায় বিভ্রতকর অবস্থায় পড়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন (এসএমপি) পুলিশ। এসএমপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অনেক সময় এসএমপি দুটি জোনের দুই ডিসিকেই পাত্তা দেন না তাদের অধিনস্ত অনেক ওসি-এসআই-এএসআই। কারণ এসএমপির সদর দপ্তর কিংবা রাজনৈতীক শেল্টার রয়েছে তাদের পিছনে। অপরাধ করলেও নাকি তাদের রক্ষাকর্তা রয়েছেন। যদিও অপরাধের ঘটনায় ‘গুরুদÐের’ আওতায় চাকরিচ্যুত করার ঘটনা হাতে গোনা মাত্র। যার কারণে এসব শাস্তিকে গায়ে লাগাচ্ছেন না অপরাধ প্রবণ পুলিশ সদস্যরা। অনেক সময় সংবাদ মাধ্যমে এসএমপি পুলিশের নানা রকম অপরাধ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেও তা আমলে নেয় না উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যার ফলে সাধারণ ভোক্তভোগীরা ভয়ে অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না পুলিশের ওপেন হাউজ ডে নামক অনুষ্টানে। ফলে আরো বেপরোয়া হচ্ছেন তারা এবং অন্য পুলিশ সদস্যরা অপরাধ-অপকর্মে জড়াতে উৎসাহী হচ্ছেন। যদিও ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধে যারা জড়িয়েছেন বা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন সেগুলো তেমন প্রকাশ পাচ্ছে না।
এদিকে পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, যে কোনো পর্যায়ে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ পেলেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেটি দেখা হয়। সে কারণে বাহিনীতে শাস্তির উদাহরণও আছে অহরহ।
পুলিশ সদর দফতর থেকে জানানো হয়েছে, বিগত ২০১৭ থেকে চলতি ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে এক লাখ তিন হাজার ১৭০ পুলিশ সদস্যকে ‘লঘুদন্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে ‘গুরুদন্ড দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৮০০ জনকে।
আর গত ১২ মে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসে বাংলাদেশ সরকারের সরবরাহ করা তথ্য অনুসারে, দেশের ২ লাখ ১৩ হাজার আইন প্রয়োগকারী বাহিনী সদস্যের মধ্যে প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ২০২১ সালে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে। বিগত ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার বা মোট বাহিনীর ৫৫ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্তত ১ হাজার ৬৯২টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। ২০২১ সালে মোট ১৭ হাজার ৯৬৬ জন সদস্য সতর্কতা, তিরস্কার বা অস্থায়ী বেতন হ্রাসের মতো ছোটখাটো শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন, এবং ২ হাজার ৩৮৮ জন বরখাস্ত বা ডিমোশনের মতো বড় শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন।
ইদানিং সিলেটে এক পুলিশ পুত্রকে মাদকদ্রব্য দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টায় ৩ পুলিশ সদস্য ও নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনা, বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এসএমপিতে। এসএমপির আলোচিত দুই ঘটনায় ৫ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে এসএমপির বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ হেফাজতে রায়হান নামে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় ৪ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত ও ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ সদর দপ্তরের পিআইও শাখায় কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক আবু সায়েদের ছেলে সাইফুর রহমান আসাদ (১৮)কে গত ১৩ অক্টোবর শাহজালার (রাহ.) মাজার এলাকা থেকে এসএমপি’র পুলিশ লাইন্সে কর্মরত তিন পুলিশ সদস্য তল্লাশির নামে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় অভিযুক্ত তিন পুলিশ কনস্টেবল মো.জুনু হোসেন জয়, ইমরান মিয়াও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চলতি মাসের ৩ ডিসেম্বর সিলেট মহানগর পুলিশ লাইন্সে নায়েক প্রনজিত তার নামে ইস্যুকৃত শটগান দিয়ে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রুবেল মিয়ার মাথা ফাটানোর ঘটনার পরদিন দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এখনো এসএমপির অনেক পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে আবাসিক হোটেল নামের পতিতালয়, জুয়া, ভারতীয় তীর শিলং নামের জুয়া, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বখরা আদায়ের অভিযোগ থাকলে তাদের ব্যাপারে উদাসিন রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে এসএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সুদীপ দাস জানান, ‘ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা অবশ্যই ঘৃণ্য কাজ। এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া দ্বিতীয় ঘটনায়ও নেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
তবে এসএমপি কমিশনার নিশারুল আরিফ সম্প্রতি পুলিশের বার্ষিক কার্যক্রম পরির্দশণ শেষে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনামূলক এক অনুষ্টানে স্পষ্ট জানিয়েছেন, পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তিনি। কোন রকম ‘অপরাধী পুলিশদের’ ছাড় দিচ্ছেন না তারা। খারাপ কাজের জন্য রয়েছে তিরস্কার আর ভালো কাজের জন্য রয়েছে পুরষ্কার।

৪৫৭ পড়েছেন