• ২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ২৭শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

সিলেট কারাগারে ভূয়া পরিচয়-জালিয়াতি করে ১৫০ জনের চাকরি : এক তাজুল কারাগারে

admin
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
সিলেট কারাগারে ভূয়া পরিচয়-জালিয়াতি করে ১৫০ জনের চাকরি : এক তাজুল কারাগারে

Sharing is caring!

আব্দুল হালিম সাগর: জেলা কোটার সুযোগ নিতে ঠিকানা পাল্টে, মিথ্যা তথ্য ও ভূয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় দেড়শজন কারারক্ষী চাকরি করার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এসব কারারক্ষীদের একেক জন প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে সিলেট কারাগারে চাকরি করছেন ভূয়া পরিচয়ে। দায় সারা জবাব হিসাবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ভূয়া কাগজপত্র দিয়ে সিলেট কারাগারে চাকরি নেওয়া কারো কোনো তথ্য বা এ ব্যাপারে কারো অভিযোগ নেই। কিন্তু এবার বের হতে শুরু করেছে থলের বিড়াল। সিলেট কারাগারে গড়ে উঠেছে কুমিল্লার একটি শক্ত সিন্ডিকেট। যে কয়টি ভূয়া চাকরির অভিযোগ সামনে আসছে তার সব গুলোই হয়েছে কুমিল্লা সিন্ডিকেটের হাত ধরে। নিয়ম অনুযায়ী কারারক্ষী নিয়োগের সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। যদি কারো এধরনের তথ্যগত বিভ্রান্তি থাকে এবং এই বিষয় নজরে আসে তাহলে তার চাকুরিচ্যুতি ঘটে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ সমস্ত বিষয়গুলো ডিআইজ প্রিজন অফিস থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু ভ‚য়া পরিচয়ে নিয়োগকৃত ১৫০ জনের অভিযোগ নিয়ে কারাকর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যাথা নেই।
জানা যায়, সিলেটের দুটি কারাগারে ভূয়া তথ্য দিয়ে প্রায় দেড়শ কারারক্ষী কাজ করছেন। এদেরই একজন কবির হোসেন। তিনি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বানগাঁও এলাকার বাসিন্দা উল্লেখ করে সিলেট জেলা কারাগারে চাকরি নিয়েছেন। কিন্তু তার আসল বাড়ি কুমিল্লায়। জেলা কোটায় সুবিধা নিতেই ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন বলে জানান তিনি। ভূল তথ্য দিয়ে চাকরি নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কবির হোসেন। কিন্তু হুমকি দিয়ে বলেন কারোর কিছু করার নেই,তার বিপক্ষে। কবিরের মতোই মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিয়েছেন কারারক্ষী আবদুল মতিন। নিয়োগপত্র অনুযায়ী তার বাড়ির ঠিকানা হবিগঞ্জ জেলার গোবিন্দপুরের বানেস্বর পুর গ্রামে। কিন্তু তারও আসল বাড়ি কুমিল্লায়। স্থায়ী ঠিকানা, স্কুল সার্টিফিকেট ও পুলিশ ভেরিফিকেশনেরও জাল সনদ টাকার বিনিময়ে নিয়েছেন বলে জানান কয়েকজন কারারক্ষী। নিজের নাম ইকরাম হোসেন হলেও সাখাওয়াত হোসেন নামে এক ব্যক্তির নিয়োগপত্র কৌশলে ব্যবহার করে কারারক্ষী হিসেবে চাকরি করেছেন প্রায় ১৭ বছর। ইকরাম হোসেন যিনি ভূয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে কারারক্ষী নং- ২২০৮৮ (সাময়িক বরখাস্তকৃত)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্য থেকে কারারক্ষী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সাখাওয়াত হেসেনসহ ২৫ জনকে প্রাথমিকভাবে কারারক্ষী পদে নির্বাচিত করেন কারা উপমহাপরিদর্শক। সে সময় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মো. সাখাওয়াত হোসেন ওরফে ইকরাম কৌশলে প্রকৃত সাখাওয়াত হোসেনের ঠিকানা ব্যবহার করে এবং নিয়োগপত্রে নিজের ছবি ব্যবহার করে কারারক্ষী পদে যোগ দেন। পরে তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হলে বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কুলাউড়ার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম এশু। কারারক্ষী পদে নিয়োগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়েছিল। কিন্তু পরে আর যোগদানপত্র পাননি। চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। তবে দেড় যুগ পর জানতে পারেন প্রতারণার মাধ্যমে তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ওই পদে চাকরি করছেন আরেকজন। কারারক্ষী হিসেবে তার চাকরি হয়েছে ১৮ বছর আগে। তার ক্রমিক নম্বর ২২০১৪। কিন্তু কুমিল্লার জহিরুল ইসলাম নামে একজন নামপরিচয় ব্যবহার করে কুলাউড়ার জহিরুল খাঁন এশু’র চাকরি করছেন। কুলাউড়ার জহিরুল চাকরি ফিরে পেতে গত বছরের নভেম্বরে রিট আবেদন করেছেন হাইকোর্টে। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের দেওয়া রুলে কারারক্ষী পদে ৮৮ জনের নিয়োগে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে আদালতের সামনে। এতে দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু এখনো কোন জবাব দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের এই জাল নিয়োগে বড় অফিসারদেরও সংযোগ রয়েছে বলে জানান সিলেট কারাগারের কারারক্ষীরা। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে নতুন ডিআইজি সগির উদ্দিন যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে সম্প্রতি তাজুল নামের এক কারারক্ষিকে কুমিল্লা থেকে আটক করেছে র‌্যাব। ফলে ভূয়া নিয়োগ প্রাপ্তদের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। র‌্যাবের হাতে আটক কারারক্ষীর নাম তাজুল ইসলাম (৪২), বাবার নাম প্রয়াত কালা মিয়া ও মায়ের নাম ফিরোজা বেগম। অথচ ২২ বছর ধরে তিনি কারারক্ষীর চাকরিতে ছিলেন ‘মঈন উদ্দিন খান’ নামে। এমন একটি স্পর্শকাতর পদে তিনি ভ‚য়া পরিচয় দিয়ে ও তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়েছিলেন। ঘটনাটি ২২ বছর পর জানতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ। এদিকে তাজুল ইসলামও বিপদ আঁচ করতে পেরে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপন করেন। অবশেষে র‌্যাবের সহায়তায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে র‌্যাব-১১ ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-২ কুমিল্লার সদস্যরা প্রতারণার মাধ্যমে কারারক্ষীর চাকরি করা তাজুল ইসলামকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে তিন সেট কারারক্ষী ইউনিফর্ম, একটি জ্যাকেট, একটি রেইনকোট ও ভ‚য়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জব্দ করা হয়।
যে ভাবে আটক হয় তাজুল: তাজুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের দক্ষিণ শশীদল গ্রামে। যে মঈন উদ্দিন খানের পরিচয়ে তাজুল প্রায় দুই যুগ সরকারি চাকরি করেছেন, সেই মঈন উদ্দিন খানের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর গ্রামে। মঈনের বাবার নাম নুর উদ্দিন খান। আসলে কারারক্ষীর চাকরি পাওয়ার কথা ছিল এই মঈনেরই। ২০০১ সালে কারারক্ষী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে মঈন ও তাজুল দুজনেই আবেদন করেছিলেন। তাজুল পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। আর মঈন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে শারীরিক ফিটনেস, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। বলা হয়েছিল, যাঁরা চাকরিতে ঠিকবেন, তাঁদের নিয়োগপত্র স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হবে। তাজুল তখন জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন। র‌্যাব অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, তাজুল তাঁর দুই সহযোগীকে নিয়ে মঈনের বাড়িতে যান। তাঁরা নিজেদের কারা কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে দাবি করেন। তাঁরা মঈনের কাছে, ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় নিয়োগ হবে না বলে জানান। তখন মঈন বলেন, ঘুষ দিয়ে তিনি চাকরি করবেন না। তাজুল ও তাঁর সহযোগীরা এরপর চলে আসেন। পরে কুমিল্লার তাজুল ইসলাম হবিগঞ্জের মঈনের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে কারারক্ষী পদে চাকরি নেন। ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনপ্রাপ্তির জন্য এনআইডির দরকার হয়। তখন তাজুল কারারক্ষী পদে উত্তীর্ণ মঈন খানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে একটি আইডি কার্ড তৈরি করেন। পরে ২০২০ সালে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সিলেট বিভাগে ২০০ জন কারারক্ষী বেআইনিভাবে কাজ করছেন। সিলেটের ওই ২০০ জনের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়। তখন হবিগঞ্জের মাধবপুরে মঈন উদ্দিন খানের তথ্যও যাচাই করা হয়। একপর্যায়ে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপমহাপরিদর্শক মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেন। এতে কারারক্ষী মঈন উদ্দন খান সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কি না, তা জানতে চান। ইউপি চেয়ারম্যান জবাবে জানান, মঈন উদ্দিন খান কারারক্ষী নন। তিনি তাঁদের এলাকার ছেলে, ওষুধ ব্যবসায়ী। কারা কর্তৃপক্ষের এসব তৎপরতা জানতে পেরে তাজুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫-২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি নেন। এরপর থেকে তিনি আর যোগদান করেননি। এদিকে মঈন উদ্দিন খান তাঁর চাকরি বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে চাকরি দেওয়ার জন্য কারাকর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। একপর্যায়ে চাকরি না পেয়ে তিন আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর প্রতারক তাজুল ইসলামকে তদন্ত কমিটি ডাকে। কিন্তু তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হননি তাজুল। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকরি করার অভিযোগে গত ৪ আগস্ট সিলেটের জালালাবাদ থানায় মামলা করে কারা কর্তৃপক্ষ। পরে কারা কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে র‌্যাবের সহযোগিতা কামনা করে। ১২ জানুয়ারি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তাজুলের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এই জালিয়াতির বিষয়ে র‌্যাব দপ্তরে তাজুল ইসলামকে গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, তাজুলকে মামলার তন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

৫৭৬ পড়েছেন